প্রথমে বলা হয়, হযরত সুলাইমান আল্লাহর এ অনুগ্রহের জন্য এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, “আমাকে পাখির ভাষার জ্ঞান দেয়া হয়েছে” এ বাক্যে তো প্রথমত পাখি শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার ফলে প্রত্যেকটি আরব ও আরবী জানা লোক এ শব্দটিকে পাখি অর্থে গ্রহণ করবে। কারণ এখানে এমন কোন পূর্বাপর প্রসঙ্গ বা সম্পর্ক নেই যা এ শব্দটিকে রূপক বা অপ্রকৃত অর্থে ব্যবহার করার পথ সুগম করতে পারে।
দ্বিতীয়ত এ মূলে ব্যবহৃত “তাইর” শব্দের অর্থ পাখি না হয়ে যদি মানুষের কোন দল থাকে, তাহলে তার জন্য “মানতিক” (বুলি) শব্দ না বলে “লুগাত” বা “লিসান” (অর্থাৎ ভাষা) শব্দ বলা বেশী সঠিক হতো। আর তাছাড়া কোন ব্যক্তির অন্য কোন মানব গোষ্ঠীর ভাষা জানাটা এমন কোন বিরাট ব্যাপার নয় যে, বিশেষভাবে সে তার উল্লেখ করবে। আজকাল আমাদের মধ্যে হাজার হাজার লোক অনেক বিদেশী ভাষা জানে ও বোঝে। এটা এমন কি কৃতিত্ব যে জন্য একে মহান আল্লাহর অস্বাভাবিক দান ও অনুগ্রহ গণ্য করা যেতে পারে?
এরপর বলা হয়, “সুলাইমানের জন্য জিন, মানুষ ও পাখি সেনাদল সমবেত করা হয়েছিল।” এ বাক্যে প্রথমত জিন, মানুষ ও পাখি তিনটি পরিচিত জাতির নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ তিনটি শব্দ তিনটি বিভিন্ন ও সর্বজন পরিচিতি জাতির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তারপর এ শব্দগুলো ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এদের কোনটির রূপক ও অপ্রকৃত অর্থে বা উপমা হিসেবে ব্যবহারের সপক্ষে কোন পূর্বাপর প্রাসাঙ্গিক সূত্রও নেই। ফলে ভাষার পরিচিত অর্থগুলোর পরিবর্তে অন্য অর্থে কোন ব্যক্তি এগুলোকে ব্যবহার করতে পারেনা। তাছাড়া “মানুষ” শব্দটি “জিন” ও “পাখি” শব্দ দু’টির মাঝখানে বসেছে, যার ফলে জিন ও পাখি আসলে মানুষ প্রজাতিরই দু’টি দল ছিল এ অর্থ গ্রহণ করার পথে কোন সুস্পষ্ট বাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। যদি এ ধরণের অর্থ গ্রহণ করা উদ্দেশ্য হতো তাহলে مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ وَالطَّيْرِ না বলে বলা হতো الْجِنِّ وَالطَّيْرِ مِنَ الْإِنْسِ সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে বলা হয়, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম পাখির খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। এ সময় হুদহুদকে অনুপস্থিত দেখে তিনি একথা বলেন। যদি এ পাখি মানুষ হয়ে থাকে এবং হুদহুদও কোন মানুষের নাম হয়ে থাকে তাহলে কমপক্ষে তিনি এমন কোন শব্দ বলতেন যা থেকে বেচারা পাঠক তাকে প্রাণী মনে করতো না। দলের নাম বলা হচ্ছে পাখি এবং তার একজন সদস্যের নাম বলা হচ্ছে হুদহুদ , এরপরও আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে মানুষ মনে করে নেব, আমাদের কাছে এ আশা করা হচ্ছে।
তারপর হযরত সুলাইমান বলেন, হুদহুদ হয় তার নিজের অনুপস্থিতির সঙ্গত কারণ বলবে নয়তো আমি তাকে কঠিন শাস্তি দেব অথবা তাকে জবাই করে ফেলবো। মানুষকে হত্যা করা হয়, ফাঁসি দেয়া হয়, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, জবাই করে কে? কোন ভয়ংকর পাষাণ হৃদয় ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ প্রতিশোধ স্পৃহায় পাগল হয়ে গেলে হয়তো কাউকে জবাই করে ফেলে। কিন্তু আল্লাহর নবীর কাছেও কি আমরা এ আশা করবো যে, তিনি নিজের সেনাদলের এক সদস্যকে নিছক তার গরহাজির (Deserter) থাকার অপরাধে জবাই করার কথা ঘোষণা করে দেবেন এবং আল্লাহর প্রতি এ সুধারণা পোষণ করবো যে, তিনি এ ধরণের একটি মারাত্মক কথার উল্লেখ করে তার নিন্দায় একটি শব্দও বলবেন না?
আর একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে, হযরত সুলাইমান আলাহিস সালাম এ হুদহুদের কাছে সাবার রাণীর নামে পত্র দিয়ে পাঠাচ্ছেন এবং সেটি তাদের কাছে ফেলে দিতে বা নিক্ষেপ করতে বলছেন (القه اليهم) । বলা নিষ্প্রয়োজন, এ নির্দেশ পাখিদের প্রতি দেয়া যেতে পারে কিন্তু কোন মানুষকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে তাকে এ ধরণের নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া একেবারে অসঙ্গত হয়। কেউ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে থাকলে সে একথা মেনে নেবে যে, এক দেশের বাদশাহ অন্য দেশের রাণীর নামে পত্র দিয়ে নিজের রাষ্ট্রদূতকে এ ধরণের নির্দেশ সহকারে পাঠাতে পারে যে, পত্রটি নিয়ে রাণীর সামনে ফেলে দাও বা নিক্ষেপ করো। আমাদের মতো মামুলি লোকেরাও নিজেদের প্রতিবেশীর কাছে নিজের কোন কর্মচারীকে পাঠাবার ক্ষেত্রেও ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের যে প্রাথমিক রীতি মেনে চলি হযরত সুলাইমানকে কি তার চেয়েও নিম্নমানের মনে করতে হবে? কোন ভদ্রলোক কি কখনো নিজের কর্মচারীকে বলতে পারে, যা আমার এ পত্রটি অমুক সাহেবের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে আয়?
এসব নিদর্শন ও চিহ্ন পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, এখানে হুদহুদ অভিধানিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সে মানুষ নয় বরং একটি পাখি ছিল। এখন যদি কোন ব্যক্তি একথা মেনে নিতে প্রস্তুত না হয় যে, কুরআন হুদহুদের বলা যেসব কথা উদ্ধৃত করছে একটি হুদহুদ তা বলতে পারে, তাহলে তার পরিষ্কার বলে দেয়া উচিত আমি কুরআনের একথাটি মানি না। কুরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন শব্দগুলোর মনগড়া অর্থ করে তার আড়ালে নিজের অবিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখা জঘন্য মুনাফিকী ছাড়া আর কিছুই নয়।