মূলে “সহীক” শব্দ বলা হয়েছে এটি ‘সাহক’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। “সাহক” এর আসল মানে হচ্ছে পিষ্ট করা। কোন জায়গাকে এমন অবস্থায় “সাহীক” বলা হয় যখন তা এতবেশী গভীর হয় যে, তার মধ্যে কোন জিনিস গেলে তা টুকরো টুকরো বা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখানে চিন্তা ও নৈতিক চরিত্রের অধঃপতনকে এমন গভীর খাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে যার মধ্যে পড়ে গিয়ে মানুষের সমস্ত কলকব্জা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়।
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
“এবং এ সমস্ত কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত করেছি।”
এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান দেখানোর যে হুকুম উপরে দেয়া হয়েছে তার দাবী কি এই যে, কুরবানীর পশুগুলোকে যখন আল্লাহর ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদেরকে কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না? তাদের পিঠে চড়া অথবা পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দেয়া কিংবা তাদের দুধ পান করা কি আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান দেখাবার বিরোধী নয়? আরবের লোকেরা একথাই মনে করতো। তারা এ পশুগুলোকে একেবারেই আরোহীশূন্য অবস্থায় সুসজ্জিত করে নিয়ে যেতো। পথে তাদের থেকে কোন প্রকার লাভবান হওয়া তাদের দৃষ্টিতে ছিল পাপ। এ ভুল ধারণা দূর করার জন্য এখানে বলা হচ্ছে, কুরবানীর জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তোমরা এ পশুদের থেকে লাভবান হতে পারো। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিরোধী নয়। এ কথাটিই এ সম্পর্কিত হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) ও হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, নবী ﷺ দেখলেন এক ব্যক্তি উটের লাগাম ধরে পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে এবং সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে আছে। তিনি বললেন, “ওর পিঠে সওয়ার হয়ে যাও” সে বললো, এটা হজ্জের সময় কুরবানী করার জন্য নিয়ে যাওয়া উট। বললেন, “তাতে কি, সওয়ার হয়ে যাও।”
মুফাসসিরগণের মধ্যে ইবনে আব্বাস (রা.), কাতাদাহ, মুজাহিদ, দ্বাহহাক ও আতা খোরাসানী এ মত পোষণ করেছেন যে, এ আয়াতে “একটি নির্দিষ্ট সময়” মানে হচ্ছে, “যতক্ষণ পর্যন্ত পশুকে কুরবানীর জন্য নির্বাচিত ও কুরবানীর পশু নামে আখ্যায়িত না করা হয়।” এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষ এ পশুগুলো থেকে কেবলমাত্র ততক্ষণ পর্যন্ত লাভবান হতে পারে যতক্ষণ তারা তাদেরকে কুরবানীর পশু নামে আখ্যায়িত করে না। যখনই তারা তাদেরকে কুরবানীর পশু বানিয়ে আল্লাহর ঘরে নিয়ে যাবার নিয়ত করে তখনই তাদের থেকে আর কোন প্রকার লাভবান হবার অধিকার তাদের থাকে না। কিন্তু এ ব্যাখ্যা মোটেই সঠিক বলে মনে হয় না। প্রথমত, এ অবস্থায় ব্যবহার করার ও লাভবান হবার অনুমতি দেওয়াটাই অর্থহীন। কারণ কুরবানীর পশু ছাড়া অন্য পশুদের থেকে লাভবান হবার বা না হবার ব্যাপারে কবেই বা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল যে, সু্স্পষ্ট অনুমতির মাধ্যমে তা দূর করার প্রয়োজন দেখা দেয়? তারপর আয়াত পরিষ্কার বলছে, এমন সব পশু ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে যাদের ওপর “আল্লাহর নিদর্শন” শব্দ প্রযুক্ত হয়। আর একথা সুস্পষ্ট যে, এটি কেবলমাত্র তখনই হতে পারে যখন তাদেরকে কুরবানীর পশু গণ্য করা হয়।
অন্য তাফসীরকারগণ যেমন উরওয়া ইবনে যুবাইর ও আতা ইবনে আবি রিবাহ বলেন, “নির্দিষ্ট সময়” অর্থ হচ্ছে “কুরবানীর সময়।” কুরবানীর পূর্বে এ কুরবানীর পশুগুলো সওয়ারীর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, এদের দুধও পান করা যায়, এদের বাচ্চাও গ্রহণ করা যেতে পারে এবং এদের পশম ও চুল ইত্যাদিও কাটা যেতে পারে। ইমাম শাফেঈ এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। হানাফীগণ যদিও প্রথম ব্যাখ্যাটির সমর্থক তবুও সেখানে এতটুকু অবকাশ বের করেছেন যে, প্রয়োজনের শর্তে লাভবান হওয়া জায়েয।
দুই, এ আয়াত থেকে জানা গেছে, আল্লাহর নামে কুরবানী করাই হচ্ছে আসল জিনিস। কুরবানী কখন করা হবে, কোথায় করা হবে, কিভাবে করা হবে--- এ নিয়মটির এ বিস্তারিত নিয়মাবলী মোটেই কোন মৌলিক বিষয় নয়। বিভিন্ন যুগের, জাতির ও দেশের নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে এ বিস্তারিত বিষয়াবলীতে পার্থক্য ছিল। কিন্তু সবার মূল প্রাণশক্তি ও উদ্দেশ্য একই রয়েছে।
أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّ نَشْتَرِكَ فِى الأَضَاحِى الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ
“রসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের হুকুম দিয়েছেন আমরা যেন কুরবানীতে উটের ক্ষেত্রে সাতজন এবং গরুর ক্ষেত্রে সাতজন শরীক হয়ে যাই।”
ابْعَثْهَا قِيَامًا مُقَيَّدَةً ، سُنَّةَ اَبِى الْقَاسِم صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
“পা বেঁধে তাকে দাঁড় করিয়ে দাও। এটা হচ্ছে আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত।”
আবু দাউদ জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ উটের বাম পা বেঁধে রেখে বাকি তিন পায়ের ওপর তাকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। তারপর তার হলকুমে বর্শা নিক্ষেপ করতেন। কুরআন নিজেও এ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করেছেঃ إِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا “যখন তাদের পিঠ জমিতে ঠেকে যায়।” একথা এমন অবস্থায় বলা হয় যখন পশু দাঁড়িয়ে থাকে এবং তারপর জমির ওপর পড়ে যায়। অন্যথায় শুইয়ে দিয়ে কুরবানী দিয়ে কুরবানী করা অবস্থায় পিঠ তো আগে থেকেই জমির সাথে লেগে থাকে।
যবেহ করার সময় بِسْمِ اللَّهِ اللَّهِ أَكْبَرُ বলার পদ্ধতি এখান থেকেই গৃহীত হয়েছে। ৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا “তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও।” আর ৩৭ আয়াতে বলা হয়েছে لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ “যাতে আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াতের ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করো।”
হাদীসে কুরবানী করার সময় নাম উচ্চারণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ধৃত হয়েছে।
যেমন
(১) بِسْمِ اللَّهِ واللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ
“আল্লাহর নামে এবং আল্লাহ সবচেয়ে বড়, হে আল্লাহ! তোমারই সম্পদ এবং তোমারই জন্য হাজির।”
(২) اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا الله اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا الله اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ
“আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, হে আল্লাহ! তোমারই সম্পদ এবং তোমারই জন্য হাজির।”
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ- لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ, اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ
(৩) “আমি একনিষ্ঠ হয়ে আমার চেহারা এমন সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই। অবশ্যই আমার নামায ও কুরবানী এবং আমার বাঁচা ও মরা সবই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমি আনুগত্যের শির নতকারীদের অন্তর্ভুক্ত। হে আল্লাহ! তোমারই সম্পদ এবং তোমারই জন্য হাজির।”
مَا قُطِعَ (اَوْ مَا بَانَ) مِنَ الْبَهِيمَةِ وَهِىَ حَيَّةٌ فَهِىَ مَيْتَةٌ
“এখনো জীবিত আছে এমন পশুর যে গোশত কেটে নেয়া হয় তা মৃত পশুর গোশত (এবং হারাম)।”
إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَلاَ الى الْوَانِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ-
“আল্লাহ তোমাদের চেহারা-সুরাত ও তোমাদের রঙ দেখেন না বরং তিনি দেখন তোমাদের মন ও কার্যকলাপ।”
এক্ষেত্রে একথা জেনে নেয়া উচিত যে, এ প্যারায় কুরবানীর যে হুকুম দেয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র হাজীদের জন্য নয় এবং শুধুমাত্র মক্কায় হজ্জের সময় কুরবানী করার জন্য নয় বরং প্রত্যেক সমর্থ মুসলমান যেখানেই সে থাকুক না কেন তার জন্য ব্যাপকভাবে এ হুকুম দেয়া হয়েছে, যাতে সে পশুদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করার নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার দায়িত্ব পালন করতে এবং এই সঙ্গে নিজের স্থানে হাজীদের অবস্থার সাথে শরীক হয়ে যেতেও পারে। হজ্জ সম্পাদন করার সৌভাগ্য না হলেও কমপক্ষে হজ্জের দিনগুলোতে আল্লাহর ঘরের সাথে জড়িত হয়ে হাজীগণ যেসব কাজ করতে থাকেন সারা দুনিয়ার মুসলমানরা সেসব কাজ করতে থাকবে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এ বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।
এছাড়াও অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকেও একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী ﷺ মদীনা তাইয়্যেবায় অবস্থানের সমগ্র সময়ে নিজেই প্রত্যেক বছর বকরা ঈদের সময় কুরবানী করতেন এবং তাঁরই সুন্নাত থেকে মুসলমানদের মধ্যে এ পদ্ধতির প্রচলন হয়। মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজায় হযরত আবু হুরাইরার (রা.) এ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছেঃ
مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখার পরও কুরবানী করে না তার আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছে না আসা উচিত।”
এ হাদীসটির সকল রাবীই সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য। মুহাদ্দিসগণ শুধুমাত্র রেওয়ায়াতটির মারফূ’ (অর্থাৎ যার বর্ণনার ধারাবাহিকতা সরাসরি নবী ﷺ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে) অথবা মওকূফ (যার বর্ণনার ধারাবাহিকতা সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছে শেষ হয়ে গেছে) হবার ব্যাপারে দ্বিমত ব্যক্ত করেছেন। (হাদীসটির বিশুদ্ধতা নিয়ে কোন মতভেদ হয়নি) তিরমিযীতে ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
أَقَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّى
“নবী ﷺ মদীনায় দশ বছর থাকেন এবং প্রত্যেক বছর কুরবানী করতে থাকেন।” বুখারীতে হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
مَنْ كَانَ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلاَةِ فَلْيُعِدْ وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكُهُ ، وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ
“যে ব্যক্তি নামাযের আগে যবেহ করলো তার আবার কুরবানী করা উচিত। আর যে ব্যক্তি নামাযের পরে কুরবানী করে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে মুসলমানদের পথ পেয়ে গেছে।”
আর একথা সবার জানা যে, কুরবানীর দিন মক্কায় এমন কোন নামায হতো না যার পূর্বে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের বিরোধী হতো এবং পরে করা হতো তার অনুকূল। কাজেই নিশ্চিতরূপেই এ উক্তি হজ্জের সময় মক্কায় নয় বরং মদীনায় করা হয়।
মুসলিমে জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা.) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নবী ﷺ মদীনায় বকরা ঈদের নামায পড়ান এবং কোন কোন লোক তিনি কুরবানী করে ফেলেছেন মনে করে নিজেদের কুরবানী করে বসে। এ অবস্থা দেখে তিনি হুকুম দেন, যারা আমার পূর্বে কুরবানী করেছে তাদের আবার কুরবানী করতে হবে।
কাজেই একথা সকল প্রকার সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে যে, বকরা ঈদের দিন সাধারণ মুসলমানরা সারা দুনিয়ায় যে কুরবানী করে এটা নবী ﷺ প্রবর্তিত সুন্নাত। তবে এখানে এ কুরবানী ওয়াজিব অথবা শুধুমাত্র সুন্নাত নিছক এ বিষয়েই মতবিরোধ দেখা যায়। ইবরাহীম নাখঈ, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম মুহাম্মাদ এবং এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আবু ইউসুফও একে ওয়াজিব মনে করতেন। কিন্তু শাফেঈ ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মতে এটা শুধুমাত্র মুসলমানদের সুন্নাত। সুফিয়ান সাওরীও বলতেন, কেউ কুরবানী না দিলে কোন ক্ষতি নেই। তবুও উম্মতে মুসলিমার কোন একজন আলেমও একথা বলেন না যে, মুসলমানরা একমত হয়ে যদি তা পরিহার করে তবুও কোন ক্ষতি নেই। এ নতুন কথা শুধু আমাদের যুগের কোন কোন লোকের উর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভাবন যাদের জন্য নিজের প্রবৃত্তিই কুরআন এবং প্রবৃত্তিই সুন্নাত।
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْظ(ايت : ١٩٠)
وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُمْ مِنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْظ (ايت : ١٩١)
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِظ (ايت : ١٩٢)
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْظ (ايت : ٢١٦)
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌظ (ايت : ٢٤٤)
অনুমতি ও হুকুম দেয়ার মধ্যে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান। আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী অনুমতি নাযিল হয় হিজরীর প্রথম বছরের যিলহজ্জ মাসে এবং হুকুম নাযিল হয় বদর যুদ্ধের কিছু পূর্বে দ্বিতীয় হিজরীর রজব অথবা শাবান মাসে।
হযরত সোহাইব রুমী (রা.) যখন হিজরত করতে থাকেন তখন কুরাইশ বংশীয় কাফেররা তাঁকে বলে, তুমি এখানে এসেছিলে খালি হাতে। এখন অনেক ধনী হয়ে গেছো।
যেতে চাইলে তুমি খালি হাতে যেতে পারো। নিজের ধন-সম্পদ নিয়ে যেতে পারবে না। অথচ তিনি নিজে পরিশ্রম করেই এ ধন-সম্পদ উপার্জন করেছিলেন। কারো দান তিনি খেতেন না। ফলে বেচারা হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং সবকিছু ঐ জালেমদের হাওয়ালা করে দিয়ে এমন অবস্থায় মদীনায় পৌঁছেন যে, নিজের পরনের কাপড়গুলো ছাড়া তাঁর কাছে আর কিছুই ছিল না।
হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) ও তাঁর স্বামী আবু সালামাহ (রা.) নিজেদের দুধের বাচ্চাটিকে নিয়ে হিজরত করার জন্য বের হয়ে পড়েন। বনী মুগীরাহ (উম্মে সালামাহর পরিবারের লোকেরা) তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তারা আবু সালামাহকে বলে, তোমার যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো কিন্তু আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারো না। বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রীকে রেখে দিয়ে চলে যান। এরপর বনী আবদুল আসাদ (আবু সালামাহর বংশের লোকেরা) এগিয়ে আসে এবং তারা বলে, শিশুটি আমাদের গোত্রের। তাকে আমাদের কাছে দিয়ে দাও। এভাবে মা ও বাপ উভয়ের কাছ থেকে শিশু সন্তানকেও ছিনিয়ে নেয়া হয়। প্রায় এক বছর পর্যন্ত হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) স্বামী ও সন্তানদের শোকে ছটফট করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত বড়ই কঠিন বিপদের মধ্যদিয়ে নিজের শিশু সন্তানটি পুনরুদ্ধার করে মক্কা থেকে এমন অবস্থায় বের হয়ে পড়েন যে, একজন নিসঙ্গ স্ত্রীলোক কোলে একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে উটের পিঠে বসে আছেন। এমন পথ দিয়ে তিনি চলছেন যেখান দিয়ে সশস্ত্র কাফেলা যেতে ভয় পেতো।
আইয়াশ ইবনে রাবীআহ আবু জেহেলের বৈপিত্রেয় ভাই ছিলেন। হযরত উমরের (রা.) সাথে হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে যান। পিছে পিছে আবু জেহেল নিজের এক ভাইকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যায়। সে মায়ের নামে মিথ্যা বানিয়ে বলে, আম্মাজান কসম খেয়েছেন আইয়াশের চেহারা না দেখা পর্যন্ত রোদ থেকে ছায়ায় যাবেন না এবং মাথায় চিরুনীও লাগাবেন না। কাজেই তুমি গিয়ে একবার শুধু তাঁকে চেহারা দেখিয়ে দাও তারপর চলে এসো। তিনি মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভক্তির আতিশয্যে তাদের সঙ্গ নেন। পথে দুই ভাই মিলে তাকে বন্দী করে এবং তাকে নিয়ে মক্কায় এমন অবস্থায় প্রবেশ করে যখন তার আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং দুই ভাই চিৎকার করে যাচ্ছিল, “হে মক্কাবাসীরা! নিজেদের নালায়েক ছেলেদেরকে এমনিভাবে শায়েস্তা করো যেমন আমরা করেছি।” দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি বন্দী থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত একজন দুঃসাহসী মুসলমান তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মক্কা থেকে মদীনায় যারাই হিজরত করেন তাদের প্রায় সবাইকেই এ ধরনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ও জালেমরা তাদেরকে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে বের হয়ে আসতে দেয়নি।
وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ
“যদি আল্লাহ লোকদেরকে একজনের সাহায্যে অন্যজনকে প্রতিহত না করতে থাকতেন তাহলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি বড়ই করুণাময়।” (২৫১ আয়াত)