৫১ ) এরও আগে আমি ইবরাহীমকে শুভ বুদ্ধি ও সত্যের জ্ঞান দান করেছিলাম এবং আমি তাকে খুব ভালোভাবেই জানতাম। ৫৩
۞ وَلَقَدْ ءَاتَيْنَآ إِبْرَٰهِيمَ رُشْدَهُۥ مِن قَبْلُ وَكُنَّا بِهِۦ عَـٰلِمِينَ ٥١
৫২ ) সে সময়ের কথা স্মরণ করো ৫৪ যখন সে তাঁর নিজের বাপকে ও জাতিকে বলেছিল, “এ মূর্তিগুলো কেমন, যেগুলোর প্রতি তোমরা ভক্তিতে গদগদ হচ্ছো?”
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِۦ مَا هَـٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِىٓ أَنتُمْ لَهَا عَـٰكِفُونَ ٥٢
৫৩ ) তারা জবাব দিলঃ “আমাদের বাপ-দাদাদেরকে আমরা এদের ইবাদাতরত অবস্থায় পেয়েছি।”
قَالُوا۟ وَجَدْنَآ ءَابَآءَنَا لَهَا عَـٰبِدِينَ ٥٣
৫৪ ) সে বললো, “তোমরাও পথভ্রষ্ট এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যেই অবস্থান করছিল।”
قَالَ لَقَدْ كُنتُمْ أَنتُمْ وَءَابَآؤُكُمْ فِى ضَلَـٰلٍۢ مُّبِينٍۢ ٥٤
৫৫ ) তারা বললো, “তুমি কি আমাদের সামনে তোমার প্রকৃত মনের কথা বলছো, না নিছক কৌতুক করছো?” ৫৫
قَالُوٓا۟ أَجِئْتَنَا بِٱلْحَقِّ أَمْ أَنتَ مِنَ ٱللَّـٰعِبِينَ ٥٥
৫৬ ) সে জবাব দিল, “না, বরং আসলে তোমাদের রব তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব এবং এদের স্রষ্টা। এর স্বপক্ষে আমি তোমাদের সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছি।
قَالَ بَل رَّبُّكُمْ رَبُّ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ٱلَّذِى فَطَرَهُنَّ وَأَنَا۠ عَلَىٰ ذَٰلِكُم مِّنَ ٱلشَّـٰهِدِينَ ٥٦
৫৭ ) আর আল্লাহর কসম, তোমাদের অনুপস্থিতিতে আমি তোমাদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে অবশ্যি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।” ৫৬
وَتَٱللَّهِ لَأَكِيدَنَّ أَصْنَـٰمَكُم بَعْدَ أَن تُوَلُّوا۟ مُدْبِرِينَ ٥٧
৫৮ ) সে অনুসারে সে সেগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললো ৫৭ এবং শুধুমাত্র বড়টিকে ছেড়ে দিল, যাতে তারা হয়তো তার দিকে ফিরে আসতে পারে। ৫৮
فَجَعَلَهُمْ جُذَٰذًا إِلَّا كَبِيرًۭا لَّهُمْ لَعَلَّهُمْ إِلَيْهِ يَرْجِعُونَ ٥٨
৫৯ ) (তারা এসে মূর্তিগুলোর এ অবস্থা দেখে) বলতে লাগলো, “আমাদের ইলাহদের এ অবস্থা করলো কে, বড়ই জালেম সে।”
قَالُوا۟ مَن فَعَلَ هَـٰذَا بِـَٔالِهَتِنَآ إِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٥٩
৬০ ) (কেউ কেউ) বললো, “আমরা এক যুবককে এদের কথা বলতে শুনেছিলাম, তাঁর নাম ইবরাহীম।”
قَالُوا۟ سَمِعْنَا فَتًۭى يَذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهُۥٓ إِبْرَٰهِيمُ ٦٠
৫৩.
আমি এখানে
رشد শব্দের অনুবাদ করেছি “শুভবুদ্ধি ও সত্যের জ্ঞান” রুশদ এর অর্থ হচ্ছে সঠিক ও বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য করে সঠিক কথা বা পথ অবলম্বন করা এবং বেঠিক কথা ও পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া। এ অর্থের প্রেক্ষিতে “রুশদ” এর অনুবাদ “সত্যনিষ্ঠা”ও হতে পারে। কিন্তু যেহেতু রুশদ শব্দটি কেবলমাত্র সত্যনিষ্ঠ নয় বরং এমন সত্যজ্ঞানের ভাব প্রকাশ করে যা হয় সঠিক চিন্তা ও ভারসাম্যপূর্ণ সুষ্ঠ বুদ্ধি ব্যবহারের ফলশ্রুতি তাই আমি “শুভবুদ্ধি ও সত্যের জ্ঞান” এই দু’টি শব্দকে একত্রে এর অর্থের কাছাকাছি পেয়েছি।
“ইবরাহীমকে তার সত্যজ্ঞান ও শুভবুদ্ধি দান করেছিলাম।” অর্থাৎ সে যে সত্যের জ্ঞান ও শুভবুদ্ধির অধিকারী ছিল তা আমিই তাঁকে দান করেছিলাম।
“আমি তাঁকে খুব ভালোভাবে জানতাম।” অর্থাৎ আমি চোখ বন্ধ করে তাকে এ দান করিনি। আমি জানতাম সে কেমন লোক। সব জেনেশুনেই তাঁকে দান করেছিলাম। اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ “আল্লাহ ভালো জানেন নিজের রিসালাত কাকে সোপর্দ করবেন।” (আন’আমঃ ১২৪) এর মধ্যে কুরাইশ সরদাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে যে আপত্তি করতো তার প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। তারা বলতো, এ ব্যক্তির মধ্যে এমন কি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যে, আল্লাহ আমাদের বাদ দিয়ে তাঁকেই রিসালাতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছেন? এর জবাব কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেয়া হয়েছে। এখানে কেবলমাত্র এতটুকু সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, এ প্রশ্ন ইবরাহীম সম্পর্কেও হতে পারতো। বলা যেতে পারতো যে, সারা ইরাক দেশে একমাত্র ইবরাহীমকেই কেন এ অনুগ্রহে অভিসিক্ত করা হলো? কিন্তু আমি জানতাম ইবরাহীমের মধ্যে কি যোগ্যতা আছে। তাই তাঁর সমগ্র জাতির মধ্য থেকে একমাত্র তাঁকেই এ অনুগ্রহ দান করার জন্য বাছাই করা হয়।
ইতিপূর্বে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পবিত্র সীরাতের বিভিন্ন দিক সূরা বাকারার ১২৪ থেকে ১৪১ ও ২৫৮ থেকে ২৬০, আন’আমের ৭৪ থেকে ৮১, তাওবার ১১৪, হূদের ৬৯ থেকে ৭৪, ইবরাহীমের ৩৫ থেকে ৪১, আল হিজরের ৫১ থেকে ৬০ এবং আন নাহলের ১২০ থেকে ১২৩ আয়াতে আলোচিত হয়েছে। এর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে ভালো হবে।
৫৪.
সামনের দিকে যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, তা পড়ার আগে একথাগুলো মনের মধ্যে তাজা করে নিতে হবে যে, কুরাইশরা হযরত ইবরাহীমের সন্তান ছিল। কাবাঘর তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। আর ইবরাহীমের আওলাদও ইবরাহীমী কাবার খাদেম হবার কারণেই কুরাইশরা যাবতীয় সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিল। আজ এ যুগে এবং আরবের বহু দুরবর্তী এলাকার পরিবেশে হযরত ইবরাহীমের এ কাহিনী শুধুমাত্র একটি শিক্ষণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবেই দেখা যায় কিন্তু যে যুগে ও পরিবেশে প্রথম প্রথম একথা বলা হয়েছিল, তা দৃষ্টি সম্মুখে রাখলে অনুভূত হবে যে, কুরাইশদের ধর্ম ও তাদের পৌরহিত্যের ওপর এটা এমন একটা তীক্ষ্ণ কশাঘাত ছিল, যা একেবারে তার মর্মমূলে আঘাত হানতো।
৫৫.
এ বাক্যটির শাব্দিক অনুবাদ হবে, “তুমি কি আমাদের সামনে সত্য পেশ করছো, না খেলা করছো?” কিন্তু এর আসল অর্থ ওটাই যা উপরে অনুবাদে বলা হয়েছে। নিজেদের ধর্মের সত্যতার প্রতি তাদের বিশ্বাস এত বেশী ছিল যে, তারা গুরুত্ব সহকারে কেউ এ কথা বলতে পারে বলে কল্পনাও করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই তারা বললো, তুমি নিছক ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও খেলা-তামাশা করছো, না কি প্রকৃতপক্ষে এটাই তোমার চিন্তাধারা?
৫৬.
অর্থাৎ যদি তোমরা যুক্তির সাহায্যে কথা বুঝতে অপারগ হয়ে থাকো তাহলে আমি তোমাদেরকে কার্যত দেখিয়ে দেবো যে, এরা অসহায়, সামান্যতম ক্ষমতাও এদের নেই এবং এদেরকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক নয়। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ দর্শনের মধ্যে একথা তাদের সামনে কেমন করে প্রমাণ করবেন, এর কোন বিস্তারিত বিবরণ হযরত ইবরাহীম (আ) এ সময় দেননি।
৫৭.
অর্থাৎ যে সময় পূজারী ও রক্ষণাবেক্ষণকারীরা উপস্থিত ছিল না সে সময় সুযোগ পেয়েই হযরত ইবরাহীম (আ) তাদের কেন্দ্রীয় ঠাকুরঘরে প্রবেশ করলেন এবং মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললেন।
৫৮.
“তার দিকে” কথাটির মধ্যে যে ইঙ্গিত রয়েছ তা বড় মূর্তিটির দিকেও হতে পারে আবার হযরত ইবরাহীমের দিকেও। যদি প্রথমটি হয় তাহলে এটি হবে হযরত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে তাদের আকীদা বিশ্বাসের প্রতি একটি বিদ্রূপাত্মক কটাক্ষের সমার্থক। অর্থাৎ যদি তারা মনে করে থাকে সত্যিই এরা ইলাহ, তাহলে তাদের এ বড় ইলাহটির ব্যাপারে সন্দেহ হওয়া উচিত যে, সম্ভবত বড় ইলাহ কোন কারণে ছোট ইলাহদের প্রতি বিরূপ হয়ে গিয়ে তাদের সবাইকে কচুকাটা করে ফেলেছেন। অথবা বড় ইলাহটিকে জিজ্ঞেস করো যে, হুযুর! আপনার উপস্থিতিতে একি ঘটে গেলো? কে এ কাজ করলো? আপনি তাকে বাধা দিলেন না কে? আর যদি দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা হয় তাহলে বুঝা যাবে যে, এ কাজের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীমের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, নিজেদের মূর্তিগুলোর এ দুরবস্থা দেখে হয়তো তাদের দৃষ্টি আমার দিকে ফিরে আসবে এবং তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তখন তাদের সাথে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলার সুযোগ আমি পেয়ে যাবো।