একটি দলে আছেন প্রাচীন তাফসীরকারগণ এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে তাফসীরকারীদের বৃহত্তম অংশ। তারা এর অর্থ বর্ণনা করেন, “সামেরী রসূল অর্থাৎ জিব্রীলকে যেতে দেখে নিয়েছিল এবং তাঁর পদাংক থেকে এক মুঠো মাটি উঠিয়ে নিয়েছিল। আর এই মাটি যখন বাছুরের মূর্তির মধ্যে রাখা হয়েছিল তখন তার অলৌকিক মহিমায় তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল প্রাণ স্পন্দন এবং একটি জীবন্ত বাছুরের মত হাম্বা রব তার মুখ থেকে বের হতে শুরু হয়েছিল।” অথচ সত্যিই যে এমনটি হয়েছিল তা অবশ্যি কুরআন বলছে না। কুরআন স্রেফ এতটুকু বলছে যে, হযরত মূসার প্রশ্নের জবাবে সামেরী একথা বানিয়ে বলেছিল। এ অবস্থায় আমরা বুঝতে পারছি না, মুফাসিরগণ কেমন করে একে একটি সত্য ঘটনা এবং কুরআন বর্ণিত যথার্থ সত্য মনে করে বসলেন।
দ্বিতীয় দলটি সামেরীর কথার অন্য একটি অর্থ করেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সামেরী আসলে বলেছিল, “আমি রসুল অর্থাৎ মূসার দ্বীনের মধ্যে এমন দুর্বলতা দেখেছিলাম যা অন্যেরা দেখতে পায়নি। তাই আমি একদিক থেকে তাঁর পদাংক অনুসরণ করেছিলাম কিন্তু পরে তা ত্যাগ করেছিলাম।” এ ব্যাখ্যাটি সম্ভবত সর্বপ্রথম করেন আবু মুসলিম ইসফাহানী। তারপর ইমাম রাযী একে নিজের তাফসীরে উদ্ধৃত করে এর প্রতি নিজের সমর্থন প্রকাশ করেন। বর্তমানে আধুনিক তাফসীরকারদের অধিকাংশই এ অর্থটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু তারা এ কথা ভুলে গেছেন যে, কুরআন ধাঁ ধাঁ ও হেঁয়ালির ভাষায় নাযিল হয়নি। বরং পরিষ্কার ও সাধারণের বোধগম্য সহজ-সরল আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। একজন সাধারণ আরববাসী নিজের ভাষায় প্রচলিত স্বাভাবিক বাগধারা অনুযায়ী এর বক্তব্য বুঝতে সক্ষম। আরবী ভাষায় সাধারণ প্রচলিত বাকরীতি ও দৈনন্দিন কথোপকথনের শব্দাবলী সম্পর্কে অবগত কোন ব্যক্তি কখনো একথা মেনে নিতে পারে না যে, সামেরীর এ সামেরীর এ মনোভাব প্রকাশ করার জন্য সহজ-সরল আরবী ভাষায় এমন সব শব্দ ব্যবহার করা হবে যা এ আয়াতের তাফসীরকারগণ বলেছেন। অথবা একজন সাধারণ আরবীয় একথাগুলো শুনে কখনো এমন অর্থ গ্রহণ করতে পারে না যা এ তাফসীরকারগণ বর্ণনা করেছেন। অভিধান গ্রন্থ থেকে কোন একটি শব্দের এমন একাধিক অর্থ গ্রহণ করা যা বিভিন্ন প্রবাদে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং তার মধ্য থেকে কোন একটি অর্থ নিয়ে এমন একটি বাক্যের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া যেখানে একজন সাধারণ আরব কখনোই এ শব্দটিকে এ অর্থে ব্যবহার করে না-এটাতো ভাষাজ্ঞান হতে পারে না, তবে বাগাড়ম্বর হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। ‘ফরহংগে আসেফীয়া’ নামক উর্দু অভিধান খানি অথবা ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারী’ হাতে নিয়ে যদি কোন ব্যক্তি যথাক্রমে তাদের উর্দু ও ইংরেজী রচনাগুলো মধ্যে এ ধরনের কৃতিত্ব ফলাতে থাকেন, তাহলে সম্ভবত নিজেদের কথার দু-চারটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনেই তাদের লেখকরা চিৎকার করে উঠবেন। সাধারণত কুরআনের এ ধরনের ব্যাখ্যা এমন সময় করা হয় যখন এক ব্যক্তি কোন আয়াতের সহজ-সরল অর্থ দেখে নিজে নিজেই একথা মনে করে থাকে যে, এখানে তো আল্লাহ তা’আলা বড়ই অসাবধান হয়ে গেছেন, এসো আমি তাঁর কথা এমনভাবে পেশ করে দিই যার ফলে তাঁর ভুলের পরদা ঢেকে যাবে এবং তাঁর বক্তব্য নিয়ে লোকদের হাসাহাসি করার সুযোগ থাকবে না।
এ বিবৃত চিন্তা পরিহার করে যে ব্যক্তিই এ বক্তব্য পরম্পরায় এ আয়াতটি পড়বে সে সহজে বুঝতে পারবে যে, সামেরী ছিল একজন ফিতনাবাজ ব্যক্তি। সে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ধোকা ও প্রতারণার একটি বিরাট পরিকল্পনা তৈরী করেছিল। সে কেবল একটি সোনার বাছুর তৈরী করে যে কোন কৌশলে তার মধ্যে গো-বৎসের হামবা রব সৃষ্টি করে দেয়নি এবং সমগ্র জাতি অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকদের প্রতারিত করেনি বরং সে আরো দুঃসাহসী হয়ে খোদ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকেও এমটি প্রতারণাপূর্ণ গল্প শুনিয়ে দিল। সে দাবী করলো, আমি এমন কিছু দেখেছি যা অন্যেরা দেখেনি। সাথে সাথে এ গল্পও শুনিয়ে দিল যে, রসুলের পদাংকের এক মুঠো মাটিই এ কেরামতি দেখিয়েছে। রসূল বলে সে জিব্রীলকেও নির্দেশ করতে পরে, যেমন প্রাচীন তাফসীরকারগণ মনে করেছেন। কিন্তু যদি একথা মনে করা হয় যে, রসূল শব্দটি বলে সে হযরত মূসাকে নির্দেশ করেছে, তাহলে এটা তার আর একটা প্রতারণা। সে এভাবে হযরত মূসাকে মানসিক উৎকোচ দিতে চাচ্ছিল, যাতে তিনি এটাকে তাঁর নিজের পদাংকের অলৌকিকতা মনে করে গর্বিত হন এবং নিজের অন্যান্য কেরামতির প্রচারণার জন্য সামেরীর প্রতারণা হিসেবেই পেশ করছে, নিজের পক্ষ থেকে প্রকৃত ঘটনা হিসেবে পেশ করছে না। তাই এতে এমন দূষণীয় কিছু ঘটেনি যে, তা প্রক্ষালনের জন্য অভিধান গ্রন্থগুলোর সাহায্যে অযথা বাগাড়ম্বর করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। বরং পরবর্তী বাক্যগুলোতে হযরত মূসা যেভাবে তাকে ধিক্কার ও অভিশাপ দিয়েছেন এবং তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছেন তা থেকে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, তার বানানো এ প্রতারণাপূর্ণ গল্প শোনার সাথে সাথেই তিনি তা তার মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেছিলেন।