একঃ প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত মুশরিক সমাজগুলোর এই সম্মিলিত বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে যে, তারা আল্লাহকে সকল খোদার প্রধান খোদা, প্রধান উপাস্য ও পরমেশ্বর হিসেবে মেনে নেয় কিন্তু একমাত্র তাঁকেই আরাধ্য, উপাস্য, মাবুদ ও খোদা হিসেবে মানতে প্রস্তুত হয় না।
দুইঃ আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে মুশরিকরা চিরকাল দু’ভাগে বিভক্ত করে এসেছে। একটি হচ্ছে, অতি প্রাকৃতিক (Super natural) খোদায়ী ক্ষমতা। কার্যকারণ পরম্পরার ওপর এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং মুশরিকরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য এর দোহাই দেয়। এই খোদায়ীর ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সাথে অতীতের পুণ্যবান লোকদের আত্মা, ফেরেশতা (দেবতা), জিন, নক্ষত্র এবং আরো অসংখ্য সত্তাকে শরীক করে। তাদের কাছে প্রার্থনা করে। পূজা ও উপাসনার অনুষ্ঠানাদি তাদের সামনে সম্পাদন করে। তাদের আস্তানায় ভেট ও নজরানা দেয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের খোদায়ী (অর্থাৎ শাসন কর্তৃত্ব) ক্ষমতা। জীবন বিধান নির্ধারণ করার ও নির্দেশের আনুগত্য লাভ করার অধিকার তার আয়ত্বাধীন থাকে। পার্থিব বিষয়াবলীর ওপর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্ণ ক্ষমতা তার থাকে। দুনিয়ার সকল মুশরিক সম্প্রদায় প্রায় প্রতি যুগে এই দ্বিতীয় প্রকারের খোদায়ী কর্তৃত্বকে আল্লাহর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অথবা তার সাথে রাজপরিবার, ধর্মীয় পুরোহিত ও সমাজের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালের মনীষীদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছে। বেশীর ভাগ রাজপরিবার এই দ্বিতীয় অর্থে খোদায়ীর দাবীদার হয়েছে। তাদের এই দাবীকে শক্তিশালী করার জন্য আবার তারা সাধারণভাবে প্রথম অর্থের খোদাদের সন্তান হবার দাবী করেছে। এ ব্যাপারে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো তাদের ষড়যন্ত্রে অংশীদার হয়েছে।
তিনঃ নমরুদের খোদায়ী দাবীও এই দ্বিতীয় ধরনের ছিল। সে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। নিজেকে পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা ও পরিচালক বলে সে দাবী করতো না। সে একথা বলতো না যে, বিশ্ব-জগতের সমস্ত কার্যাকারণ পরম্পরার ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। বরং তার দাবী ছিল, আমি এই ইরাক দেশ এবং এর অধিবাসীদের একচ্ছত্র অধিপতি। আমার মুখের কথাই এ দেশের আইন। আমার ওপর আর কারো কর্তৃত্ব নেই। কারো সামনেই আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না। ইরাকের যেকোন ব্যক্তি এসব দিক দিয়ে আমাকে রব বলে মেনে নেবে না অথবা আমাকে বাদ দিয়ে আর কাউকে রব বলে মেনে নেবে, সে বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক।
চারঃ ইবরাহীম আল্লাইহিস সালাম যখন বললেন, আমি একমাত্র রব্বুল আলামীনকে খোদা, মাবুদ ও রব বলে মানি, তাঁর ছাড়া আর সবার খোদায়ী, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব অস্বীকার করি, তখন কেবল এতটুকু প্রশ্ন সেখানে দেখা দেয়নি যে, জাতীয় ধর্ম ও ধর্মীয় মাবুদদের ব্যাপারে তাঁর এই নতুন আকীদা ও বিশ্বাস কতটুকু সহনীয়, বরং এই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে যে, জাতীয় রাষ্ট্র ও তার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা-কর্তৃত্বের ওপর এই বিশ্বাস যে আঘাত হানছে তাকে উপেক্ষা করা যায় কেমন করে? এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ) বিদ্রোহের অপরাধে নমরুদের সামনে আনীত হন।
তালমূদের বর্ণনা মতে, তারপর সেই বাদশাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীমকে বন্দী করা হয়। দশ দিন তিনি কারাগারে অবস্থান করেন। অতঃপর বাদশাহর কাউন্সিল তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার যে ঘটনা ঘটে তা সূরা আম্বিয়ার ৫ম রুকূ’, আনকাবুতের ২য় ও ৩য় রুকূ’ এবং আস সাফ্ফাতের ৪র্থ রুকূ’তে বর্ণিত হয়েছে।