আর মানুষের ব্যাপারে বলা যায়, সে অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন সৃষ্টিগত হুকুম প্রবর্তনের মাধ্যমে পরিণত হোক বা ইলহামের সাহায্যে এ ধরনের কোন অদৃশ্য জ্ঞান ও হুকুম লাভ করে তা কার্যকর করুক, সর্বাবস্থায় যে কাজটি সে সম্পন্ন করেছে সেটি যদি শরীয়াতের কোন বিধানের পরিপন্থী হয় তাহলে তার গুনাহগার হওয়া থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কারণ মানব সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকটি মানুষ শরীয়াতের বিধান মেনে চলতে বাধ্য। কোন মানুষ ইলহামের মাধ্যমে শরীয়াতের কোন বিধানের বিরুদ্ধাচরণের হুকুম লাভ করেছে এবং অদৃশ্য জ্ঞানের মাধ্যমে এ বিরুদ্ধচারণকে কল্যাণকর বলা হয়েছে বলেই শরীয়াতের বিধানের মধ্য থেকে কোন বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা তার জন্য বৈধ হয়ে গেছে, শরীয়াতের মূলনীতির মধ্যে কোথাও এ ধরনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি।
এটি এমন একটি কথা যার ওপর কেবলমাত্র শরীয়াতের আলেমগণই যে একমত তাই নয় বরং প্রধান সুফীগণও একযোগে একথা বলেন। আল্লামা আলুসী বিস্তারিতভাবে আবদুল ওয়াহ্হাব শি’রানী, মুহীউদ্দিন ইবনে আরাবী, মুজাদ্দিদে আলফিসানি, শায়খ আবদুল কাদের জীলানী, জুনায়েদ বাগদাদী, সাররী সাক্তী, আবুল হাসান আন্নুরী, আবু সাঈদ আলখাররায্, আবুল আব্বাস আহমদ আদ্দাইনাওয়ারী ও ইমাম গাযযালীর ন্যায় খ্যাতনামা বুযর্গগণের উক্তি উদ্ধৃত করে একথা প্রমাণ করেছেন যে, তাসাউফপন্থীদের মতেও কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিধান বিরোধী ইলহামকে কার্যকর করা যার প্রতি ইলহাম হয় তার জন্যও বৈধ নয়।
এখন কি আমরা মেনে নেবো যে, এ সাধারণ নিয়ম থেকে মাত্র একজন মানুষকে পৃথক করা হয়েছে এবং তিনি হচ্ছেন হযরত খিযির? অথবা আমরা মনে করবো, খিযির কোন মানুষ ছিলেন না বরং তিনি আল্লাহর এমনসব বান্দার দলভুক্ত ছিলেন যারা আল্লাহর ইচ্ছার আওতাধীনে (আল্লাহর শরীয়াতের আওতাধীনে নয়) কাজ করেন?
প্রথম অবস্থাটি আমরা মেনে নিতাম যদি কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতো যে, হযরত মূসাকে যে ‘বান্দা’র কাছে অনুশীলন লাভের জন্য পাঠানো হয়েছিল তিনি মানুষ ছিলেন। কিন্তু কুরআন তার মানুষ হবার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেনি বরং কেবলমাত্র (আরবী---------) (আমার বান্দাদের একজন) বলে ছেড়ে দিয়েছে। আর একথা সুস্পষ্ট, এ বাক্যাংশ থেকে ঐ বান্দার মানব সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া অপরিহার্য হয় না। কুরআন মজীদে বিভিন্ন জায়গায় ফেরেশতাদের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যেমন দেখুন সূরা আম্বিয়া ২৬ আয়াত এবং সূরা যুখরুফ ১৯ আয়াত। তাছাড়া কোন সহী হাদীসেও নবী ﷺ থেকে এমন কোন বক্তব্য উদ্ধৃত হয়নি যাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হযরত খিযিরকে মানব সম্প্রদায়ের একজন সদস্য গণ্য করা হয়েছে। এ অধ্যায়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীসটি সাঈদ ইবনে জুবাইর থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি উবাই ইবনে কা’ব থেকে এবং তিনি রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের নিকট পৌঁছেছে। সেখানে হযরত খিযিরের জন্য শুধুমাত্র (আরবী----------) (রুজুল) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি যদিও মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত পুরুষদের জন্য ব্যবহার করা হয় তবু শুধুমাত্র মানুষের জন্য ব্যবহার করা হয় না। কাজেই কুরআনে এ শব্দটি জিনদের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা জিনে বলা হয়েছেঃ (আরবী-----------------------------) তাছাড়া এ কথা সুস্পষ্ট যে, জিন বা ফেরেশতা অথবা অন্য কোন অদৃশ্য অস্তিত্ব যখন মানুষের সামনে আসবে তখন মানুষের আকৃতি ধরেই আসবে এবং এ অবস্থায় তাকে মানুষই বলা হবে। হযরত মারয়ামের সামনে যখন ফেরেশতা এসেছিল তখন কুরআন এ ঘটনাটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেঃ (আরবী---------------------------------) কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি যে “সেখানে তিনি একজন পুরুষকে পেলেন” হযরত খিযিরের মানুষ হবার ব্যাপারটি সুস্পষ্ট করছে না। এরপর এ জটিলতা দূর করার জন্য আমাদের কাছে হযরত খিযিরকে মানুষ নয় ফেরেশতা হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পথই থাকে না। অথবা তাঁকে আল্লাহর এমন কোন সৃষ্টি মনে করতে হবে যিনি শরীয়াতের বিধানের আওতাধীন নন বরং আল্লাহর ইচ্ছা পুরনের কাজে নিযুক্ত একজন কর্মী। প্রথম যুগের আলেমগণের কেউ কেউও এমত প্রকাশ করেছেন এবং ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীর গ্রন্থে মাওয়ারদীর বরাত দিয়ে তা উদ্ধৃত করেছেন।
কুরআন মজীতে যেভাবে তার কথা আলোচনা করেছে তা থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে চারটি কথা জানতে পারিঃ
এক, তার যুলকারনাইন (শাব্দিক অর্থ “দু’ শিংওয়ালা”) উপাধিটি কমপক্ষে ইহুদীদের মধ্যে, যাদের ইঙ্গিত মক্কার কাফেররা তার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করেছিল, নিশ্চয়ই পরিচিত হওয়ার কথা তাই একথা জানার জন্য আমাদের ইসরাঈলী সাহিত্যের শরণাপন্ন না হয়ে উপায় থাকে না যে, তারা “দু’শিংওয়ালা” হিসেবে কোন্ ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে জানতো?
জুলকারণাইন কিসসা সংক্রান্ত মানচিত্র (সূরা আল কাহফ ৬২ নং টীকা)
দুই, এ ব্যক্তির অবশ্যই কোন বড় শাসক ও এমন পর্যায়ের বিজেতা হওয়ার কথা যার বিজয় অভিযান পূর্ব থেকে পশ্চিমে পরিচালিত হয়েছিল এবং অন্যদিকে উত্তর-দক্ষিণ দিকেও বিস্তৃত হয়েছিল। কুরআন নাযিলের পূর্বে এ ধরনের কৃতিত্বের অধিকারী মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির কথাই জানা যায়। তাই অনিবার্যভাবে তাদেরই কারোর মধ্যে আমাদের তার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য ও বৈশিষ্ট্যও খুঁজে দেখতে হবে।
তিন, তাকে অবশ্যই এমন একজন শাসনকর্তা হতে হবে যিনি নিজের রাজ্যকে ইয়াজুজ মা’জুজের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য কোন পার্বত্য গিরিপথে একটি মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করেন। এ বৈশিষ্ট্যটির অনুসন্ধান করার জন্য আমাদের একথাও জানতে হবে যে, ইয়াজুজ মা’জুজ বলতে কোন্ জাতিকে বুঝানো হয়েছে এবং তারপর এও দেখতে হবে যে, তাদের এলাকার সাথে সংশ্লিষ্ট এ ধরনের কোন্ প্রাচীর দুনিয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেটি কে নির্মাণ করেছে? চার, তার মধ্যে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোসহ এ বৈশিষ্ট্যটিও উপস্থিত থাকা চাই যে, তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা হবেন। কারণ কুরআন এখানে তার এ বৈশিষ্ট্যটিকেই সবচেয়ে সুস্পষ্ট করেছে।
এর মধ্যে থেকে প্রথম বৈশিষ্ট্যটি সহজেই খুরসের (বা সাইরাস) বেলায় প্রযোজ্য। কারণ বাইবেলের দানিয়েল পুস্তকে দানিয়েল নবীর যে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তাতে তিনি ইরানীদের উত্থানের পূর্বে মিডিয়া ও পাস্যের যুক্ত সাম্রাজ্যকে একটি দু’শিংওয়ালা মেষের আকারে দেখেন। ইহুদীদের মধ্যে এ “দু’শিংধারী”র বেশ চর্চা ছিল। কারণ তার সাথে সংঘাতের ফলেই শেষ পর্যন্ত বেবিলনের সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায় এবং বনী ইসরাঈল দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্তি লাভ করে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল ৮ টীকা)
দ্বিতীয় চিহ্নটিরও বেশীর ভাগ তার সাথে খাপ খেয়ে যায় কিন্তু পুরোপুরি নয়। তার বিজয় অভিযান নিঃসন্দেহে পশ্চিমে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার সমুদ্রসীমা এবং পূর্বে বখ্তর (বলখ) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু উত্তরে বা দক্ষিণে তার কোন বড় আকারের অভিযানের সন্ধান এখনো পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়নি। অথচ কুরআন সুস্পষ্টভাবে তার তৃতীয় একটি অভিযানের কথা বর্ণনা করছে। তবুও এ ধরনের একটি অভিযান পরিচালিত হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ ইতিহাস থেকে দেখা যায়, খুরসের রাজ্য উত্তরে ককেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তৃতীয় চিহ্নটির ব্যাপারে বলা যায়, একথা প্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, ইয়াজুজ মা’জুজ বলতে রাশিয়া ও উত্তর চীনের এমনসব উপজাতিদের বুঝানো হয়েছে যারা তাতারী, মঙ্গল, হূন ও সেথিন নামে পরিচিত এবং প্রাচীন যুগ থেকে সভ্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে আসছিল। তাছাড়া একথাও জানা গেছে যে, তাদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ককেশাসের দক্ষিণাঞ্চলে দরবন্দ ও দারিয়ালের মাঝখানে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু খুরসই যে, এ প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন তা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
শেষ চিহ্নটি প্রাচীন যুগের একমাত্র খুরসের সাথেই সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। কারণ তার শত্রুরাও তার ন্যায়বিচারের প্রশংসা করেছে। বাইবেলের ইষ্রা পুস্তক একথার সাক্ষ্য বহন করে যে, তিনি নিশ্চয়ই একজন আল্লাহভীরু ও আল্লাহর অনুগত বাদশাহ ছিলেন। তিনি বনী ইসরাঈলকে তাদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রিয়তার কারণেই বেবিলনের দাসত্বমুক্ত করছিলেন এবং এক ও লা-শরীক আল্লাহর ইবাদাতের জন্য বাইতুল মাকদিসে পুনর্বার হাইকেলে সুলাইমানী নির্মাণ করার হুকুম দিয়েছিলেন।
এ কারণে আমি একথা অবশ্যি স্বীকার করি যে, কুরআন নাযিলের পূর্বে যতজন বিশ্ববিজেতা অতিক্রান্ত হয়েছেন তাদে মধ্য থেকে একমাত্র খুরসের মধ্যেই যুলকারনাইনের আলামতগুলো বেশী পরিমাণে পাওয়া যায় কিন্তু একেবারে নিশ্চয়তা সহকারে তাকেই যুলকারনাইন বলে নির্দিষ্ট করার জন্য এখনো আরো অনেক সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে। তবুও কুরআনে উপস্থাপিত আলামতগুলো যত বেশী পরিমাণে খুরসের মধ্যে বিদ্যমান, ততটা আর কোন বিজেতার মধ্যে নয়।
ঐতিহাসিক বর্ণনার জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, খুরস ছিলেন একজন ইরানী শাসনকর্তা। খৃস্টপূর্ব ৫৪৯ অব্দের কাছাকাছি যুগ থেকে তাঁর উত্থান শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি মিডিয়া (আল জিবাল) এবং লিডিয়া (এশিয়া মাইনর) রাজ্য জয় করার পর ৫৩৯ খৃস্টপূর্বাদ্বে বেবিলন জয় করেন। এরপর তার পথে আর কোন রাজশক্তির বাধা ছিল না। তার বিজয় অভিযান সিন্ধু ও সুগদ (বর্তমান তুর্কিস্তান) থেকে শুরু করে একদিকে মিসর ও লিবিয়া এবং অন্যদিকে থ্রেস ও ম্যাকডোনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আবার উত্তর দিকে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে ককেশিয়া ও খাওয়ারিযাম পর্যন্ত। বলতে গেলে সেকালের সমগ্র সভ্য জগত তাঁর শাসনাধীন ছিল।