এ ভাষণটির ওপর শুধুমাত্র সাদামাটাভাবে চোখ বুলিয়ে চলে যাওয়া যাবে, এমন পর্যায়ের ভাষণ এটি নয়। এর এমন অনেকগুলো দিক আছে যেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং যেগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন আছেঃ
একঃ এ প্রথম আমরা দেখছি হযরত ইউসুফ (আ) আল্লাহর সত্য দ্বীনের প্রচার করছেন। এর আগে তাঁর জীবন কাহিনীর যে অংশ কুরআন পেশ করেছে তাতে কেবলমাত্র তাঁর উন্নত নৈতিক চরিত্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু তাবলীগ বা প্রচারের কোন আভাস সেখানে পাওয়া যায় না। এ থেকে প্রমাণ হয়, প্রথম পর্যায়গুলো ছিল নিছক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণমূলক। নবুওয়াতের কাজ কার্যত এ কারাগার পর্যায়ে তাঁকে সোপর্দ করা হয় এবং নবী হিসেবে এটি তাঁর প্রথম দাওয়াতী ভাষণ।
দুইঃ এ প্রথম তিনি লোকদের সামনে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন। এর আগে আমরা দেখেছি তিনি যেসব অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন অত্যন্ত ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার সাথে সেগুলো গ্রহণ করতে থেকেছেন। যখন কাফেলার লোকেরা তাঁকে ধরে গোলাম বানালো, যখন তিনি মিসরে আনীত হলেন, যখন তাঁকে মিসরের আযীযের হাতে বিক্রি করা হলো, যখন তাঁকে কারাগারে পাঠানো হলো, এর মধ্যে কোন এক সময়েও তিনি একথা বলেননি যে, তিনি ইবরাহীম ও ইসহাক আলাইহিস সালামের পৌত্র এবং ইয়াকূব আলাইহিস সালামের ছেলে। তাঁর বাপ ও দাদা কেউ অপরিচিত ছিলেন না। কাফেলার লোকেরা, মাদয়ানবাসী হোক বা ইসমাঈলী উভয়েরই তাদের পরিবারের সাথে নিকট সম্পর্ক ছিল। মিসরবাসীরাও তো কমপক্ষে হযরত ইবরাহীম সম্পর্কে বেখবর ছিল না। (বরং হযরত ইউসুফ যেভাবে তাঁদের এবং হযরত ইয়াকূব ও ইসহাকের কথা বলেছেন তাতে অনুমান করা যায় এ তিনজন মনীষীর খ্যাতি মিসরে পৌঁছে গিয়েছিল।) কিন্তু হযরত ইউসুফ (আ) বিগত চার পাঁচ বছর ধরে যেমন অবস্থার সম্মুখীন হতে থেকেছেন তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কখনো নিজের বাপ-দাদাদের নাম নেননি। সম্ভবত তিনি নিজেও জানতেন, আল্লাহ তাঁকে যা কিছু বানাতে চান সেজন্য তাঁকে এসব অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখন শুধুমাত্র নিজের দাওয়াত ও তাবলীগের খাতিরে তিনি এ সত্যটি সামনে তুলে ধরলেন যে, তিনি কোন নতুন অভিনব দ্বীন পেশ করছেন না বরং তাওহীদ প্রচারের এমন একটি বিশ্বজনীন আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে যার নেতা হচ্ছে ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূব আলাইহিমুস সালাম। তাঁর এমনটি করা এজন্য জরুরী ছিল যে, সত্য দ্বীনের আহবায়ক কখনো “আমি একটি নতুন কথা বলছি যা এর আগে কেউ বলেনি” এ ধরনের দাবীর মাধ্যমে তাঁর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন না। বরং প্রথম পদক্ষেপেই তিনি একথা পরিষ্কার করে বলে দেন যে, তিনি একটি চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সত্যের দিকে আহবান জানাচ্ছেন, যা ইতিপূর্বে সব সময়ই সকল সত্যপন্থী পেশ করে এসেছেন।
তিনঃ তারপর ইউসুফ আলাইহিস সালাম নিজের বক্তব্য পেশ করার জন্য যেভাবে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তা থেকে আমরা প্রচার কৌশলের ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করি। দু’জন লোক তাদের স্বপ্ন বর্ণনা করছে। তারা নিজেদের ভক্তি ও শ্রদ্ধার কথা প্রকাশ করে তার তা’বীর জিজ্ঞেস করছে। জবাবে তিনি বলছেন, তা’বীর তো আমি অবশ্যি বলবো কিন্তু তার আগে শুনে রাখো, যে জ্ঞানের মাধ্যমে আমি তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেবো তার উৎস কি? এভাবে তাদের কথার মধ্য থেকে নিজের কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি তাদের সামনে নিজের দ্বীন পেশ করতে থাকেন। এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি সত্য প্রচারের ফিকিরে লেগে যায় এবং সে সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিরও অধিকারী হয় তাহলে কেমন চমৎকারভাবে আলোচনার মোড় নিজের দিকে ফিরিয়ে নিতে পারে। যে ব্যক্তি দাওয়াত দেবার ধান্দায় থাকে না তার সামনে সুযোগের পর সুযোগ আসতে থাকে কিন্তু কোন সুযোগেই সে নিজের কথা পেশ করার প্রয়োজন অনুভব করে না। কিন্তু যার এ ধান্দা থাকে, সে সুযোগের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকে এবং সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই নিজের কাজ শুরু করে দেয়। তবে বিচক্ষণ ও জ্ঞানী প্রচারকের সুযোগ সন্ধান এবং নির্বোধ ও অবিবেচক প্রচারকের সুযোগ সদ্ধানের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নির্বোধ প্রচারক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি না রেখে লোকদের কানে জোরপূর্বক নিজের দাওয়াত ঠেসে দেবার চেষ্টা করে তারপর অনর্থক তর্ক-বিতর্ক ও বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে তাদের মনে নিজের দাওয়াতের প্রতি উল্টো বিরক্তির সৃষ্টি করে।
চারঃ লোকদের সামনে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার সঠিক পদ্ধতি কি, একথাও এখান থেকে জানা যেতে পারে। হযরত ইউসুফ (আ) সুযোগ পেতেই ইসলামের বিস্তারিত বিধান ও নীতিগুলো পেশ করতে শুরু করেননি। বরং শ্রোতাদের সামনে দ্বীনের এমন একটি সূচনা বিন্দু তুলে ধরেন যেখান থেকে সত্যপন্থী ও মিথ্যাপন্থীদের পথ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তাওহীদ ও শিরকের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। আবার এ পার্থক্যকে এমন যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে সুস্পষ্ট করেছেন যার ফলে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন যে কোন ব্যক্তিই তা অনুভব না করে পারেন না। বিশেষ করে সে সময় যাদেরকে সম্বোধন করে তিনি একথা বলছিলেন তাদের মন-মস্তিষ্কে তীরের মতো একথা গেঁথে গিয়ে থাকবে। কারণ তারা ছিল কর্মজীবী গোলাম। নিজেদের মনের গভীরে তারা একথা ভালোভাবে অনুভব করতো যে, একজন প্রভুর গোলাম হওয়া ভালো, না একাধিক প্রভুর গোলাম হওয়া আর সারা দুনিয়ার একক প্রভু যিনি, তার বন্দেগী করা ভালো, না তার বান্দাদের বন্দেগী করা? তারপর তিনি একথাও বলেন না যে, তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করো এবং আমার দ্বীন গ্রহণ করো। বরং এক বিচিত্র ভংগীতে বলছেন, আল্লাহর কতবড় মেহেরবানী, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারো বান্দা হিসেবে পয়দা করেননি, অথচ অধিকাংশ লোক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না বরং অনর্থক নিজেরাই মনগড়া রব তৈরী করে তাদের পূজা ও বন্দেগী করছে। তারপর তিনি শ্রোতাদের অনুসৃত ধর্মের সমালোচনাও করছেন কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং কোন প্রকার মনোকষ্ট না দিয়ে। তিনি এতটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন যে, এই যেসব মাবুদ--- যাদের কাউকে তোমরা অন্নদাতা, কাউকে অনুগ্রহদাতা ও করুণাবিধান, কাউকে ভূমির অধিপতি এবং কাউকে ধন-সম্পদের মালিক অথবা স্বাস্থ্য ও রোগের একচ্ছত্র অধিপতি ও পরিচালক ইত্যাদি বলে থাকো এরা নিছক অন্তসারশূন্য নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নামগুলোর পিছনে কোন সত্যিকার অন্নদাতা, অনুগ্রহকারী, মালিক ও প্রভুর অস্তিত্ব নেই। আসল মালিক ও প্রভু হচ্ছেন মহান আল্লাহ, যাকে তোমরাও বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক বলে স্বীকার করে থাকো। তিনি এসব মালিক ও প্রভুদের কাউকে মালিকানা, প্রভুত্ব ও উপাস্য হবার ছাড়পত্র দেননি। তিনি সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা নিজের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং তাঁরই আদেশ হচ্ছে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না।
পাঁচঃ হযরত ইউসুফ (আ) কারাগারের এ আট দশ বছরের জীবন কিভাবে অতিবাহিত করেছেন এ থেকে একথাও অনুমান করা যেতে পারে। লোকেরা মনে করে, কুরআনে যেহেতু তাঁর শুধু একটি মাত্র ভাষণের উল্লেখ আছে কাজেই তিনি কেবল একবারই দ্বীনের দাওয়াত দেবার জন্য মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু প্রথমত, নবী তাঁর আসল কাজ থেকে গাফেল ছিলেন, একজন নবী সম্পর্কে এ ধারণা করা মারাত্মক ধরনের কুধারণার পর্যায়ভুক্ত। তারপর যে ব্যক্তির সত্যদ্বীন প্রচারের আগ্রহ ও ফিকির এত বেশী প্রবল ছিল যে, দু’জন লোক স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করতেই তিনি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাদের কাছে দ্বীনের তাবলীগ করতে শুরু করে দেন, তাঁর সম্পর্কে কেমন করে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, তিনি কারাবাসের এ কয়েক বছর নীরবে কাটিয়ে দিয়েছিলেন?
হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এ তা’বীরে শুধুমাত্র বাদশাহর স্বপ্নের অর্থ বর্ণনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি বরং তিনি এ সঙ্গে প্রাচুর্যের প্রথম সাত বছরে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা ও শস্য সংরক্ষণ করার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি দুর্ভিক্ষের পরে সুদিন আসার সুখবরও দিয়েছেন অথচ বাদশাহর স্বপ্নে এর কোন উল্লেখ ছিল না।
হযরত ইউসুফ (আ) তাঁর এ দাবীকে যে ভাষায় পেশ করেছেন তা থেকে সুস্পষ্টভাবে একথা প্রকাশিত হয় যে, আযীযের স্ত্রীর ভোজের মজলিসে যে ঘটনা ঘটেছিল সে সম্পর্কে মিসরের বাদশাহ পুরাপুরি অবগত ছিলেন। বরং সেটি এমনি একটি বহুল প্রচারিত ঘটনা ছিল যে, সেদিকে কেবলমাত্র একটি ইঙ্গিতই যথেষ্টে ছিল।
তারপর এ দাবীতে হযরত ইউসুফ (আ) আযীযের স্ত্রীকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যে মহিলাগুলো আংগুল কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারটি উত্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। এটি তাঁর চরম ভদ্রতা ও উন্নত হৃদয়বৃত্তির আর একটি প্রমাণ। আযীযের স্ত্রী তাঁর সাথে যে পর্যায়ের অসদ্ব্যবহার করে থাকুক না কেন তবুও তার স্বামী তাঁর উপকার করেছিলেন। তাই তার ইজ্জত-আবরুর ওপর হামলা করে কোন কথা তিনি বলতে চাননি।