যমীনের ওপর যা কিছু ঘটে গেছে তার সবকিছু সে কিয়ামতের দিন বলে দেবে, যমীন সম্পর্কে একথাটি প্রাচীন যুগে মানুষকে অবাক করে দিয়ে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ তারা মনে করে থাকবে, যমীন আবার কেমন করে কথা বলবে? কিন্তু আজ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন নতুন জ্ঞান-গবেষণা, আবিষ্কার--উদ্ভাবন এবং সিনেমা, লাউড স্পীকার, রেডিও, টেলিভিশন, টেপ রেকর্ডার ও ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির আবিষ্কারের এ যুগে যমীন তার নিজের অবস্থা ও নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী কিভাবে বর্ণনা করবে একথা অনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয়। মানুষ তার মুখ থেকে যা কিছু উচ্চারণ করে তার পূর্ণ অবয়ব বাতাসে, রেডিও তরঙ্গে, ঘরের দেয়ালে, মেঝে ও ছাদের প্রতি অণু-পরমাণুতে এবং কোন পথে, ময়দানে বা ক্ষেতে কোন কথা বলে থাকলে সেখানকার প্রতিটি অণু কণিকায় তা গেঁথে আছে। আল্লাহ যখনি চাইবেন একথাগুলোকে এসব জিনিসের মাধ্যমে তখনই হুবহু ঠিক তেমনিভাবে শুনিয়ে দিতে পারবেন যেভাবে সেগুলো একদিন মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। সে সময় মানুষ নিজের কানেই নিজের এই আওয়াজ শুনে নেবে। তার পরিচিতিজনেরাও তার এই আওয়াজ চিনে নেবে এবং তারা একে তারই কন্ঠধ্বনি ও বাকভঙ্গীমা বলে সনাক্ত করবে। তারপর মানুষ যমীনের যেখানেই যে অবস্থায় যেকোনো কাজ করেছে তার প্রতিটি নড়াচড়া ও অঙ্গভঙ্গীর প্রতিচ্ছবি তার চারপাশের সমস্ত বস্তুতে পড়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে সেসব চিত্রায়িত হয়ে রয়েছে। একেবারে নিকষ কালো আঁধারের বুকে সে কোনো কাজ করে থাকলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীন এমনসব রশ্মি রয়েছে যেগুলোর কাছে আলো-আঁধার সমান, তারা সকল অবস্থায় তার ছবি তুলতে পারে। এসব ছবি কিয়ামতের দিন একটি সচল ফিল্মের মতো মানুষের সামনে এসে যাবে এবং সারাজীবন সে কোথায় কি করেছে তা তাকে দেখিয়ে দেবে।
আসলে প্রত্যেক মানুষের কর্মকাণ্ড আল্লাহ সরাসরি জানলেও আখেরাতে যখন তিনি আদালত কায়েম করবেন তখন সেখানে যাকেই শাস্তি দেবেন ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবী পুরোপুরি পালন করেই শাস্তি দেবেন। তাঁর আদালতে প্রত্যেকটি অপরাধী মানুষের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হবে তার সপক্ষে এমনসব অকুটিল সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হবে যার ফলে তার অপরাধী হবার ব্যাপারে কারো কোন কথা বলার অবকাশ থাকবে না। সর্বপ্রথম পেশ করা হবে তার আমলনামা। সবসময় তার সাথে লেগে থাকা কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাদ্বয় তার প্রত্যেকটি কথা ও কাজ রের্কড করছেন। (সূরা কাফ-১৭ আয়াত, সূরা ইনফিতার ১০-১২ আয়াত) এ আমলনামা তার হাতে দিয়ে দেয়া হবে। তাকে বলা হবে, তোমার জীবনের এই কার্যবিবরণী পড়ো। নিজের হিসেবে নেবার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট। (বনি ইসরাঈল ১৪) মানুষ তা পড়ে অবাক হয়ে যাবে। কারণ ছোট বড় এমন কোন বিষয় নেই যা তাতে যথাযথভাবে সংযোজিত হয়নি। (আল কাহাফ ৪৯) এরপর হচ্ছে মানুষের নিজের শরীর। দুনিয়ায় এই শরীরের সাহায্যে সে সমস্ত কাজ করেছে। আল্লাহর আদালতে তার জিহবা সাক্ষ্য দেবে, সে দুনিয়ায় কি কি কথা বলেছে, তার নিজের হাত পা সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে দিয়ে সে কোন্ কোন্ কাজ করিয়েছে। (আন নূর ২৪) তার চোখজোড়া সাক্ষ্য দেবে। তার কান সাক্ষ্য দেবে, তার সাহায্যে সে কি কি কথা শুনেছে। তার শরীরের গায়ে লেপ্টে থাকা চামড়া তার যাবতীয় কাজের সাক্ষ্য দেবে। সে পেরেশান হয়ে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলবে, তোমরাও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছো? তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জবাব দেবে, আজ যে আল্লাহর হুকুমে সমস্ত জিনিস চলছে তাঁরই হুকুমে আমরাও চলছি। (হা-মীম সাজদাহ ২০ থেকে ২২) এরপরে আছে আরো অতিরিক্ত সাক্ষ্য। এই সাক্ষ্যগুলো পেশ করা হবে যমীন ও তার চারপাশের সমগ্র পরিবেশ থেকে। সেখানে নিজের আওয়াজ মানুষ নিজের কানে শুনবে। নিজের প্রতিটি কাজকর্মের প্রতিচ্ছবি নিজের চোখেই দেখবে। এর চাইতেও অগ্রসর হয়ে দেখা যাবে, মানুষের মনে যেসব চিন্তা, ইচ্ছা, সংকল্প ও উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল এবং যেসব নিয়তের মাধ্যমে সে নিজের সমস্ত কাজ করেছিল তাও সব সামনে এনে রেখে দেয়া হবে। যেমন সামনে সূরা আদিয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। এ কারণে এবং এ ধরনের চূড়ান্ত ও জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সামনে এসে যাবার পর মানুষ অবাক ও নির্বাক হয়ে যাবে। নিজের পক্ষ থেকে ওজর পেশ করার কোন সুযোগই তার থাকবে না। (আল মুরসালাত ৩৫-৩৬)