২১ ) নূহ বললোঃ হে প্রভু, তারা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ঐসব নেতার অনুসরণ করেছে যারা সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পেয়ে আরো বেশী ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে।
قَالَ نُوحٌۭ رَّبِّ إِنَّهُمْ عَصَوْنِى وَٱتَّبَعُوا۟ مَن لَّمْ يَزِدْهُ مَالُهُۥ وَوَلَدُهُۥٓ إِلَّا خَسَارًۭا ٢١
২২ ) এসব লোক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করে রেখেছে। ১৬
وَمَكَرُوا۟ مَكْرًۭا كُبَّارًۭا ٢٢
২৩ ) তারা বলেছে, তোমরা নিজেদের দেব-দেবীদের কোন অবস্থায় পরিত্যাগ করো না। আর ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগুস, ইয়াউক এবং নাসরকেও ১৭ পরিত্যাগ করো না।
وَقَالُوا۟ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّۭا وَلَا سُوَاعًۭا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًۭا ٢٣
২৪ ) অথচ এসব দেব-দেবী বহু লোককে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছে। তুমিও এসব জালেমদের জন্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না। ১৮
وَقَدْ أَضَلُّوا۟ كَثِيرًۭا ۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّـٰلِمِينَ إِلَّا ضَلَـٰلًۭا ٢٤
২৫ ) নিজেদের অপরাধের কারণেই তাদের নিমজ্জিত করা হয়েছিল তারপর আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ১৯ অতঃপর তারা আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কোন সাহায্যকারী পায়নি। ২০
مِّمَّا خَطِيٓـَٔـٰتِهِمْ أُغْرِقُوا۟ فَأُدْخِلُوا۟ نَارًۭا فَلَمْ يَجِدُوا۟ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ أَنصَارًۭا ٢٥
২৬ ) আর নূহ বললোঃ হে আমার রব, এ কাফেরদের কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না।
وَقَالَ نُوحٌۭ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى ٱلْأَرْضِ مِنَ ٱلْكَـٰفِرِينَ دَيَّارًا ٢٦
২৭ ) তুমি যদি এদের ছেড়ে দাও তাহলে এরা তোমার বান্দাদের বিভ্রান্ত করবে এবং এদের বংশে যারাই জন্মলাভ করবে তারাই হবে দুষ্কৃতকারী ও কাফের।
إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا۟ عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوٓا۟ إِلَّا فَاجِرًۭا كَفَّارًۭا ٢٧
২৮ ) হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মু’মিন হিসেবে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে তাদেরকে এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও। জালেমদের জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।
رَّبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِىَ مُؤْمِنًۭا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتِ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّـٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارًۢا ٢٨
১৬.
ষড়যন্ত্রের অর্থ হলো জাতির লোকদের সাথে নেতাদের ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা। নেতারা জাতির লোকদের হযরত নূহ আলাইহিস সালামের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করার চেষ্টা করতো। যেমন, তারা বলতোঃ “নূহ তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর কাছে অহী এসেছে তা কি করে মেনে নেয়া যায়?” (সূরা আ’রাফ ৬৩; হূদ-২৭) “আমাদের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা না বুঝে শুনে নূহের আনুগত্য করছে। তাঁর কথা যদি সত্যিই মূল্যবান হতো তাহলে জাতির নেতা ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ তাঁর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করতো।” (হূদ-২৭) “আল্লাহ যদি পাঠাতেই চাইতেন তাহলে কোন ফেরেশতা পাঠাতেন।” (আল মু’মিনূন, ২৪) এ ব্যক্তি যদি আল্লাহর প্রেরিত রসূল হতেন, তাহলে তাঁর কাছে সবকিছুর ভাণ্ডার থাকতো, তিনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানতেন এবং ফেরেশতাদের মত সব রকম মানবীয় প্রয়োজন ও অভাব থেকে মুক্ত হতেন। (সূরা হূদ, ৩১) নূহ এবং তাঁর অনুসারীদের এমন কি অলৌকিকত্ব আছে যার জন্য তাঁদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিতে হবে? (হূদ, ২৭) এ ব্যক্তি আসলে তোমাদের মধ্যে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। (আল মু’মিনূন, ২৫) প্রায় এ রকম কথা বলেই কুরাইশ নেতারা লোকদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত করতো।
১৭.
নূহের কওমের উপাস্যদের দেবীদের মধ্য থেকে এখানে সেসব দেব-দেবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তীকালে মক্কাবাসীরা যাদের পূজা করতে শুরু করেছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের বিভিন্ন স্থানে তাদের মন্দিরও বর্তমান ছিল। এটা অসম্ভব নয় যে, মহাপ্লাবনে যেসব লোক রক্ষা পেয়েছিল পরবর্তী বংশধরগণ তাদের মুখ থেকে নূহের (আ) জাতির প্রাচীন উপাস্য দেব-দেবীদের নাম শুনেছিল এবং পরে তাদের বংশধরদের মধ্যে নতুন করে জাহেলিয়াত ছড়িয়ে পড়লে তারা সেসব দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরী করে তাদের পূজা অর্চনা শুরু করেছিল।
‘ওয়াদ্দ’ ছিল ‘কুদা’আ’ গোত্রের “বনী কালব ইবনে দবরা” শাখার উপাস্য দেবতা। “দুমাতুল জানদাল” নামক স্থানে তারা এর বেদী নির্মাণ করে রেখেছিল। আরবের প্রাচীন শিলা লিপিতে তার নাম “ওয়াদ্দম আবাম” (ওয়াদ্দ বাপু) উল্লেখিত আছে। কালবীর মতে তার মূর্তি ছিল এক বিশালদেহী পুরুষের আকৃতিতে নির্মিত। কুরাইশরাও তাকে উপাস্য দেবতা হিসেবে মানতো। তাদের কাছে এর নাম ছিল “উদ্দ”। তার নাম অনুসারে ইতিহাসে “আবদে উদ্দ” নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ দেখা যায়।
“সুওয়া” ছিল হুযাইল গোত্রের দেবী। তার মূর্তি ছিল নারীর আকৃতিতে তৈরী। ইয়াম্বুর সন্নিকটস্থ “রুহাত” নামক স্থানে তার মন্দির ছিল।
“ইয়াগুস” ছিল “তায়” গোত্রের “আনউম” শাখার এবং “মাযহিজ” গোত্রের কোন কোন শাখার উপাস্য দেবতা। “মাযহিজে”র শাখা গোত্রের লোকেরা ইয়ামান ও হিজাযের মধ্যবর্তী “জুরাশ” নামক স্থানে তার সিংহাকৃতির মূর্তি স্থাপন করে রেখেছিল। কুরাইশ গোত্রেরও কোন কোন লোকের নাম আবদে ইয়াগুস ছিল বলে দেখা যায়।
“ইয়াউক” ইয়ামানের হামদান অঞ্চলের অধিবাসী হামদান গোত্রের “খায়ওয়ান” শাখার উপাস্য দেবতা ছিল। এর মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির।
“নাসর” ছিল হিমইয়ার অঞ্চলের হিমইয়ার গোত্রের “আলে যুল-কুলা” শাখার দেবতা। “বালখা” নামক স্থানে তার মূর্তি ছিল। এ মূর্তির আকৃতি ছিল শকুনের মত। সাবার প্রাচীন শিলালিপিতে এর নাম উল্লেখিত হয়েছে “নাসূর”। এর মন্দিরকে লোকেরা “বায়তে নাসূর” বা নাসূরের ঘর এবং এর পূজারীদের “আহলে নাসূর ” বা নাসূরের পূজারী বলতো। প্রাচীন মন্দিরসমূহের যে ধ্বংসাবশেষ আরব এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলসমূহে পাওয়া যায় সেসব মন্দিরের অনেকগুলোর দরজায় শকুনের চিত্র খোদিত দেখা যায়।
১৮.
এ সূরার ভূমিকাতেই আমরা এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি যে, হযরত নূহ আলাইহিস সালামের এ বদদোয়া কোন প্রকার ধৈর্যহীনতার কারণ ছিল না। বরং এ বদদোয়া তাঁর মুখ থেকে তখনই উচ্চারিত হয়েছিল যখন তাবলীগ ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে শত শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর জাতির ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়েছিলেন। হযরত মূসাও এরূপ পরিস্থিতিতেই ফেরাউন ও ফেরাউনের কওমের জন্য এ বলে বদদোয়া করেছিলেনঃ “হে প্রভু! তুমি এদের অর্থ-সম্পদ ধ্বংস করে দাও এবং তাদের দিলের ওপর মোহর লাগিয়ে দাও, এরা কঠিন আযাব না দেখা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।” তার জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেছিলেনঃ তোমার দোয়া কবুল করা হয়েছে। (ইউনূস, আয়াত ৮৮-৮৯) হযরত মূসা আলাইহিস সালামের বদদোয়ার মত নূহ আলাইহিস সালামের এ বদদোয়াও ছিল আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। তাই সূরা হূদে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
وَ اُوْحِىَ اِلَى نُوْحٍ اَنَّهُ لَنْ يُّؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ اِلاَّ مَنْ قَدْ اَمَنَ فَلاَ تَبْتَئِسْ بَمَا كَا نُوْا يَفْعَلُوْنَ
“আর অহী পাঠিয়ে নূহকে জানিয়ে দেয়া হলো, এ পর্যন্ত তোমার কওমের যেসব লোক ঈমান এনেছে এখন তারা ছাড়া আর কেউ ঈমান আনবে না। তাদের কৃতকর্মের জন্য আর দুঃখ করো না।” (হূদ, ৩৬)
১৯.
অর্থাৎ নিমজ্জিত হওয়াতেই তাদের ব্যাপারটি চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যায়নি। বরং ধ্বংস হওয়ার পরপরই তাদের রূহসমূহকে আগুনের কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ আচরণের সাথে ফেরাউন ও তার জাতির সাথে কৃত আচরণের হুবহু মিল রয়েছে। এ বিষয়টিই সূরা আল মু’মিনের ৪৫ ও ৪৬ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মু’মিন, টীকা-৬৩) যেসব আয়াত দ্বারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের আযাব বা কবরের আযাব প্রমাণিত হয় এ আয়াতটি তারই একটি।
২০.
অর্থাৎ তারা যেসব দেব-দেবীকে সাহায্যকারী মনে করতো, সেসব দেব-দেবীর কেউ-ই তাদের রক্ষা করতে আসেনি। এটা যেন মক্কাবাসীদের জন্য এ মর্মে সতর্কবাণী যে, তোমরাও যদি আল্লাহর আযাবে পাকড়াও হও তাহলে যেসব দেব-দেবীর ওপর তোমরা ভরসা করে আছো তারা তোমাদের কোন কাজেই আসবে না।